বানরের বুদ্ধি
নদীর কাছে জামগাছে থাকত একটি বানর। সারা বছর শুধু জাম খেয়ে বেঁচে থাকত সে। তিনকুলে তার কেউ ছিল না। ছিল এক বন্ধু কুমির। দুই বন্ধুতে ভারি ভাব। কুমির রোজ জামগাছের গোড়ায় আসে, ডাঙায় উঠে রোদ পোহায়। বানর বন্ধুর সঙ্গে নানা গল্পগুজব করে। সন্ধ্যে হলে কুমির তার ঘরে চলে যায়। যাবার সময় বানর তাকে বলে, বন্ধু, এই জামগুলো তোমার বউকে দিও। সে খেলে আমার ভালো লাগবে।
কুমিরের বউ ছিল খুবই লোভী। সে একদিন কুমিরকে বলল, দেখো আমার মনে একটা ইচ্ছা জাগছে, যদি রাখো তাহলে সব কিছু তোমাকে বলি। কুমির বলল — গিন্নি, তুমি মন খুলে বলো, তোমার কোন্ ইচ্ছের কথা আমি শুনিনি বলো তো? কুমিরের বউ বলল — আমার মনে হয় সারা জীবন মিষ্টি জাম খেয়ে খেয়ে তোমার বানর বন্ধুর হৃৎপিন্ডটা অমৃতের মতো হয়ে গেছে। আমি ওর হৃৎপিন্ডটা খেতে চাই। তুমি ওকে এখানে নিয়ে, এসো।
কুমির বলল — সে কী কথা, গিন্নি! বানর আমার পরম বন্ধু। তাকে আমি হত্যা করব কী করে? বউ বলল — বানরকে না নিয়ে এলে আমি মাথা খুঁড়ে মরব। কুমির আর কী করে? বউকে খুশি করার জন্য বলল, তোমাকে আর মাথা খুঁড়ে মরতে হবে না। দেখি আমি কী করতে পারি।
কুমির গেল তার বানর বন্ধুর কাছে। অন্যদিনের মতোই গল্প গুজব করতে শুরু করল। সুযোগ বুঝে এক সময় বলল, বন্ধু বানর, আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে। তোমার সঙ্গে আমার অনেক দিনের বন্ধুত্ব। বলো কথা দাও, তুমি আমার কথা রাখবে। বানর বলল — যদি সম্ভব হয়, নিশ্চয়ই তাহলে কথা রাখব। কী কথা বলো তো?
কুমির বলল — আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব, রোজ আমি তোমার বাড়িতে বেড়াতে আসি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তুমি একদিনও আমার বাড়িতে যাওনি। তোমার বৌদি ঠাট্টা করে বলে, কেমন তোমার বন্ধু ? একদিনও তো বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে এখানে নিয়ে এলে না? আজ নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। আমি নিজের হাতে পিঠে পায়েস করে রাখব। কাজেই বন্ধু, তোমাকে আজ আমার সঙ্গে যেতেই হবে। বানর বলল — বৌদিকে আমার নমস্কার জানাবে। আমি তার নিমন্ত্রণ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছি। কিন্তু বৌদি থাকে মাঝ নদীর চরের মধ্যে, সেখানে আমি যাব কেমন করে? আমরা তো সাঁতার জানি না ।
কুমির বলল — আমি তোমাকে পিঠে করে নিয়ে যাব। আজ সে তোমার জন্য মিষ্টি-টিষ্টি তৈরি করে বসে আছে, তুমি না গেলে সারারাত সে শুধু কাঁদতেই থাকবে। কুমিরের কথায় বিশ্বাস করে বানর তার পিঠে চড়ে বসল। বানরকে পিঠে নিয়ে কুমির বড়ো বড়ো ঢেউ ডিঙিয়ে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বানর কুমিরের পিঠের ওপর বসে ভীষণ ভয় পেয়েছে। কুমিরকে ডেকে সে বলল—বন্ধু, বড়ো ঢেউগুলোকে দেখে আমার ভীষণ ভয় লাগছে, তুমি সাবধানে যেও। আমি ছিটকে পড়ে গেলেই সর্বনাশ। টুক্ করে ডুবে যাব। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না। কুমির মুখে বলল — ভয় কি বন্ধু ? এই তো প্রায় আমরা এসেই গেছি।
বোকা কুমিরটা ভাবল, এবার আসল কথাটা বানরকে বললে কী হয়? ও তো আর পালাতে পারবে না, ও তো সাঁতার জানে না। সে বলল, বন্ধু, তোমাকে আমি কেন নিয়ে যাচ্ছি বলো তো? চারপাশে অনন্ত জলরাশি। সেদিকে তাকিয়ে বানরের বুকটা ছ্যাত করে উঠল। সে বলল — জানি বৈকি। তোমার বউ আমায় নেমন্তন্ন করেছে। আর তাই বুঝি আমাকে নিয়ে যাচ্ছো? কুমির বলল — পোড়া কপাল! যদি জানতে তোমায় আমি কেন নিয়ে যাচ্ছি তাহলে তুমি কখনোই আমার নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে না। বন্ধু তোমার বৌদির ইচ্ছে হয়েছে তোমার হৃৎপিন্ডটা চিবিয়ে খাবে। তাই মিথ্যে কথা বলে তোমাকে নিয়ে এলাম। এখন ভগবানের নাম করো।
কুমিরের কথা শুনে বানরের তো মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। তার হৃৎপিন্ডের স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেল। এত বড়ো বিপদেও সে সাহস হারাল না। সে বলল—ছিঃ ছিঃ বন্ধু, এই কথাটা আমায় আগে বলোনি কেন? নাঃ, বৌদিকে দেখছি হতাশ হতে হবে। আমি আমার হৃৎপিন্ডটা জামগাছে রেখে এসেছি।
কুমিরের বুদ্ধিটা একটু মোটা। সে বলল, তাহলে উপায়? তোমার হৃৎপিন্ড খেতে না পেলে আমার বউ ভীষণ রাগ করবে। বানর তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বলল — তাহলে আর কী করা যাবে, অন্য একদিন নিয়ে আসব। আজ তো আর ফিরে যাওয়া যায় । বৌদি এতরকম আয়োজন করবে, সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে। কুমির বলল — তা হয় না, চল, এখুনি সাঁতার কেটে ওই জামগাছের তলায় চলে যাই। হৃৎপিন্ডটা নিয়ে আসি। আমি জোরে জোরে সাঁতার কাটব। বেশীক্ষণ সময় লাগবে না।
কুমির ফিরে চলল জামগাছটার দিকে। বানর সবসময় ভগবানের নাম স্মরণ করছে। কুমির ফিরে এল জামগাছটার তলায়। মাটির নাগাল পেয়ে বানরের মনে হল, সে বুঝি স্বর্গে চলে এসেছে। একলাফে জামগাছের সব থেকে উঁচু ডালে গিয়ে বসল। মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাল। নিজের অদৃষ্টের কথা ভাবতে লাগল। কুমির বলল — ওকি বন্ধু, দেরী করছ কেন? বউ যে তোমার জন্য বসে আছে।
বানর বলল — ওরে বোকা কুমির, প্রাণীদের হৃৎপিন্ড একটাই থাকে, আর তা গাছে ঝুলিয়ে রাখা যায় না, তুমি বোকা বলেই আজ আমি প্রাণটা ফিরে পেলাম। কুমির মনে মনে ভাবল, তাই তো! মস্ত ভুল হয়ে গেছে। দেখা যাক বোকামিটা শোধরাতে পারি কিনা? সে বানরকে ডেকে বলল — বন্ধু আমি তোমাকে এতক্ষণ পরীক্ষা করছিলাম। নইলে আমি কি জানি না যে, প্রাণীদের একটা হৃৎপিন্ড থাকে। সেটা গাছে ফেলে রাখা যায় না। ঠাট্টা করে তোমায় একথা বলেছি। তুমি বড় ভয় পেয়েছ। এসো, ওদিকে আমার বৌ বসে আছে। বানর বলল - বটে, তুমি ভাবছ তোমার চালাকি আমি বুঝতে পারি নি ? এই বলে মুচকি হেসে বানর সেখান থেকে চলে গেল।
0 Comments