কুমোর যুধিষ্ঠির
কুমোর যুধিষ্ঠিরের তিনকুলে আপন বলতে
ঘুরিয়ে হাঁড়ি কলসি মালসা থালা বানাত। হাটবারে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করে আসত। একবার হাটের বেচাকেনা শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে বসল। কখন যে দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে খেয়াল নেই। অবশেষে সে ঘরের দিকে পা বাড়াল। কৃষ্ণপক্ষ অন্ধকার গ্রাম্য পথ। যুধিষ্ঠির আপন মনে চলেছে। হঠাৎ একদল মেঠো কুকুরের তাড়া খেয়ে যুধিষ্ঠির পড়ি কি মরি করে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকল বাড়িতে।
পোড়া অকেজো হাড়ি কলসি ভাঙা খাপরাগুলো উঁই করে রাখা ছিল উঠোনের এক কোণে। অন্ধকারে বুঝতে না পেরে সে হোঁচট খেয়ে পড়ল ওই খাপরার গাদায়। আর যায় কোথায় ? আচমকা হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ার ফলে বেচারার কপালটা গেল ফেটে। রক্তারক্তি কান্ড। কোনোরকমে ঘরে এসে ঢুকল সে। কপালের কাটা ঘা-টা শুকোল না। বরং দুদিনে সেটা দগদগে ঘায়ে পরিণত হল। অনেক দিন লেগেছিল ওই ঘা শুকোতে। তবে কাটা দাগটা রয়ে গেল যুধিষ্ঠিরের কপালে। সেই গভীর ক্ষত দাগ জীবনে মিলিয়ে যায়নি তার।
যাইহোক সুখে দুঃখে তার দিন মন্দ কাটছিল না। সেবার দেশে অজন্মা হল। খাবারের অভাবে মানুষ মরতে লাগল কাতারে কাতারে। অনেকে দেশ ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে বিদেশের দিকে রওনা হল। যুধিষ্ঠির ঠিক করল সেও এগ্রামে আর থাকবে না। একদল লোককে সঙ্গী হিসাবে পেল সে। অবশেষে নতুন এক দেশে সে এসে পৌছল।
বাঃ! কী সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি ঘর, দোকানপাট গুলোও সুন্দর। এখানকার মানুষজনের মনে যেন দুঃখ নেই। যুধিষ্ঠির ভাবল, এই দেশেই থেকে যাবে। কিন্তু কাজ তো কিছু করতে হবে। নয়তো খাবে কী? অতএব একদিন সে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেল। রাজা তখন পারিষদবর্গ নিয়ে দরবার করছিলেন। রাজার দুইপাশে সুসজ্জিত আসনে বসে আছে দুই রাজপুত্র। তারা রাজকার্য শিক্ষা করছে। কদিন আগেই রাজার ছোটো সেনাপতির মৃত্যু ঘটেছে। তাই রাজার মুখ মলিন বিষাদাচ্ছন্ন।
যুধিষ্ঠির ছিল গাট্টাগোট্টা মজবুত চেহারার। অবশ্য এই কয়েকদিনের পথের ধুলোয় আর ক্লান্তিতে সেই চেহারায় এসেছে কিছুটা মলিনতা। রাজামশাইয়ের সামনে এসে দাঁড়াল যুধিষ্ঠির। তার কপালের ক্ষতচিহ্নটার দিকে রাজার প্রথম নজর পড়ল। তারপর তার চেহারাটার ওপর তিনি চোখ বুলিয়ে ভাবলেন, এ নিশ্চয়ই কোনো বীর। কপালের দাগটা তারই প্রমাণ দিচ্ছে। লড়াইয়ের চিহ্ন। তার ওপর শক্তসমর্থ চেহারা। এর চেহারা দেখেই ওর বংশ পরিচয়, জাতের পরিচয় সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে। এ নিশ্চয়ই কোনো রাজপুত্র। ছদ্মবেশ ধারণ করেছে।
এসব ভাবনা-চিন্তা করে রাজা যুধিষ্ঠিরকে ছোটো সেনাপতির পদে বহাল করলেন। বললেন — এটাই তোমার উপযুক্ত কাজ। একথা শুনে যুধিষ্ঠির অবাক হল। কোনোরকমে জবাব দিল যে আজ্ঞে মহারাজ। দরবার কক্ষে তখন গুঞ্জন ধ্বনি উঠেছে। সকলে বলাবলি করতে লাগল। অচেনা অজানা একটা পথের লোককে সেনাপতির পদ দেওয়া কি রাজার উচিত হল? কিন্তু কেউ রাজার বিরোধিতা করতে পারল না। এমনকি বৃদ্ধ মন্ত্রীও নীরব রইল। দুই রাজপুত্রও বিরক্ত।
হাড়ি কলসী গড়ার কুমোর ভাগ্যের জোরে হয়ে গেল ছোটো সেনাপতি। সুখসম্পদের মধ্যে দিন কাটছে তখন যুধিষ্ঠিরের। জমকালো পোশাক উঠল তার পরনে। সে পেল সাজানো গোছানো সুন্দর বাড়ি এবং গাড়ি। রাজসভায় তার জন্য নির্দিষ্ট আসনও আছে। সে রোজ কোমরে তরোয়াল ঝুলিয়ে দামী পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে গাড়ি চড়ে রাজসভায় আসে। মাস গেলে মোটা টাকা মাসোহারা পায়। রাজামশাই তাকে বেশ সমীহ করেন। মহানন্দে দিনগুলো কাটাচ্ছিল যুধিষ্ঠির। হঠাৎ একদিন তার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে গেল। বাইরের শত্রু এসে এরাজ্য আক্রমণ করল। যুদ্ধ ঘোষিত হল। চারিদিকে সাজ সাজ রব। অস্ত্রেশস্ত্রে শান দেওয়া হল। যুদ্ধের জন্য সৈন্যরা প্রস্তুত হতে লাগল। যুদ্ধের জন্য গোপনে পরামর্শ করা দরকার। রাজামশাই যুধিষ্ঠিরকে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন — রাজপুত্র, আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোমার ওই কপালে গভীর দাগটা কোন যুদ্ধের চিহ্ন বহন করছে? অবশ্য এসম্পর্কে আমার আগেই জেনে নেওয়া উচিত ছিল। যাইহোক এখন বলো।
যুধিষ্ঠির হাত জোড় করে বিনীত কণ্ঠে বলল — মহারাজ, এটা কোনো অস্ত্রের আঘাত নয়। আমি আসলে এক কুমোর, নাম যুধিষ্ঠির। বাড়ির উঠোনের একধারে খাপরার স্তুপ ছিল। রাতের অন্ধকারে কুকুরের ধাওয়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে ওই খাপরার মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম। কপাল কেটে রক্তারক্তি। ছোটো একটা কাটা ধীরে ধীরে দগদগে ঘায়ে পরিণত হল। সেই থেকেই এই গভীর ক্ষতচিহ্নটা রয়ে গেছে।
যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে রাজামশায়ের মাথায় হাত। তিনি নীরবে মাথা নোয়ালেন। এ যে তার চরম লজ্জা। পরক্ষণে তিনি বললেন — শোনো, এতে তোমার কোনো দোষ নেই। ভুল আমারই। তোমার পরিচয় না জেনে তোমাকে এই পদে বহাল করেছিলাম। যাক গে, যা হবার তাই হয়ে গেছে। তুমি এখন এসো। আমি অন্য সেনাপতি খুঁজে নেব। যুধিষ্ঠির বুকে বল এনে বলল — মহারাজ, আমাকে একবার অন্তত যুদ্ধ করার সুযোগ দিন। দেখবেন আমার হাতের কসরত, তখন বুঝবেন ঠিক লোককেই সেনাপতির মর্যাদা দিয়েছেন।
রাজামশাই মাথা নেড়ে বললেন — যুধিষ্ঠির, আমি মানলাম তোমার শক্তি আছে, সাহস আছে। আছে তোমার সুন্দর সুঠাম চেহারা। কিন্তু তোমার নেই অস্ত্র প্রয়োগের শিক্ষা। তোমার বংশের কেউ কি কখনও লড়াই করেছে? অতএব তোমার ভালোর জন্য বলছি, মানে মানে এখান থেকে সরে পড়ো। সকলে জানতে পারলে তখন আর লাঞ্ছনার অন্ত থাকবে না। অতএব মুখ ভার করে যুধিষ্ঠির ফিরে এল স্বগ্রামে।
0 Comments